কবরস্থান | কাল্পনিক গল্প

   কবরস্থান 

আমরা তখন নিয়মিত ফুটবল খেলতাম।

আমাদের খেলার মাঠটা ছিল একটা বিশাল কবরস্থানের পাশে। মাঠটা ছিল অন্যান্য জায়গা থেকে কিছুটা উঁচু। এর আশেপাশে কয়েকটা ক্ষেতের আইল ছিল। আর মাঠটা ছিল লোকালয় থেকে কিছুটা দূরে।

আমাদের পাড়ায় জনি আর রনি নামে দুই ভাই ছিল। জনি ছিল বড় আর রনি ছোট। ওদের একটা ফুটবল ছিল যেটা দিয়ে আমরা সবাই মিলে খেলতাম। পুরো পাড়ায় বল বলতে কেবল ঐ একটাই ছিল। বিকেলবেলা স্কুল ছুটির পর আমরা খেলতে যেতাম।

বয়সে জনি বড় হলেও খেলায় রনির পারদর্শিতা বেশি ছিল। জনি থেকে রনি ঢের ভালো ফুটবল খেলতো। খেলায় ওরা দুই ভাই দুই দলের অধিনায়ক থাকতো। দল ভাগ করা, খেলা পরিচালনা করা এবং মাঠে কোনো প্রকার ঝগড়া বিবাদের সৃষ্টি হলে সেটার সমাধান করা ছিল ওদের দুই ভাইয়ের কাজ।

সেদিন বিকেলবেলা আমরা সবাই খেলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। বরাবরের মতো আমি ও আমার বন্ধু মামুন দুজন মিলে জনি আর রনিকে ডাকার জন্য আগেই বের হয়ে গেলাম। ওদের বাসায় গিয়ে দেখলাম জনি বসে ভাত খাচ্ছে কিন্তু রনি তখনো স্কুল থেকে আসেনি। জনিকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম ওদের আজ অপশনাল সাবজেক্টের ক্লাস চলছে তাই আসতে একটু দেরি হবে। ব্যাপার হচ্ছে ওদের দুই ভাইয়ের মধ্যে কেউ একজন না খেললে খেলাটাই ভালো লাগেনা। তাই আমরা রনি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

জনিদের ঘরে আমি, মামুন আর জনি তিনজনে মিলে খেলার প্লেন করছিলাম। একটু পর রনির আওয়াজ শোনা গেলো। সে তাড়াতাড়ি ব্যাগ রেখে স্কুল ড্রেস খুলে আমাদের খেলায় যেতে বললো। রনির আম্মু তাঁর জন্য ভাত বেড়ে রেখেছিলেন। কিন্তু রনি খেলার জন্য এতোই পাগল ছিল যে ভাত খাওয়ার কথা ভুলেই গেল। আমরাও তাঁকে তাড়াতাড়ি খেলায় যোগ দিতে বললাম।

বিছানার নিচ থেকে বল নিয়ে আমি, মামুন, জনি ও রনি হাঁটতে লাগলাম। আজকে অন্যান্য দিন থেকে অনেক দেরি হয়ে গেল। না জানি পাড়ার অন্যান্যরা আমাদের কত গালাগাল দিচ্ছে। মাঠে গিয়ে দেখি সবাই একেবারে  কোমর বেঁধে খেলার জন্য রেডি। আমরা আসার পর দেখলাম কেউ গালাগাল দিচ্ছেনা বরং আমরা খেলতে আসায় সবাই অনেক খুশি। আমরা আসার আগে ওরা দল ভাগ করে রেখেছিল। শুধু আমি, মামুন, জনি ও রনি এই চারজনকে দুইভাগে ভাগ করে দুইদলে ওরা বণ্টন করে দিল।

যথাসময়ে খেলা শুরু হল। আমরা কোনোদিকে খেয়াল না দিয়ে একটানা খেলতে লাগলাম।


খেলতে খেলতে একেবারে সন্ধ্যে গড়িয়ে এলো। আর কিছুক্ষণ পর খেলা বন্ধ হবে। হঠাৎ রনি সজোরে বলে লাথি মারলো। বলটা গড়িয়ে গড়িয়ে একেবারে কবরস্থানে চলে গেল। সন্ধ্যে হয়ে যাওয়ায় কেউ বল নেওয়ার জন্য কবরস্থানে যেতে রাজি হচ্ছিল না। আমরা একজন অন্যজনকে যাওয়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছিলাম কিন্তু নিজে কেউ যেতে রাজি হচ্ছিলাম না। অগত্যা যে বল মেরেছিল সে আনতে হবে এরকম সিদ্ধান্ত হল। তাই রনি বল আনতে কবরস্থানের দিকে আস্তে আস্তে যেতে লাগলো। সে যেতে যেতে একেবারে কবরস্থানের ভিতরে চলে গেল কিন্তু বল খুঁজে পাচ্ছিলো না। হঠাৎ সে বলটা একটা গর্তের মধ্যে দেখতে পেল। গর্তটা ছিল কবরস্থানের একেবারে উত্তর কোণে। যখনি সে বলটা গর্ত থেকে নিতে যাবে তখনি আমরা সবাই এমন একটা দৃশ্য দেখলাম যেটা দেখার জন্য আমরা একদম প্রস্তুত ছিলাম না। কেউ কোনো জিনিস যেরকম নিক্ষেপ করে আমরা দেখলাম বলটা গর্তের ভিতর থেকে কে যেন বাইরে নিক্ষেপ করলো। এমনভাবে নিক্ষেপ করলো যেন গর্তের ভিতরে কেউ আছে। এটা দেখে আমরা সবাই ভয়ে দৌড়ে মাঠ থেকে পালালাম। পাড়ায় এসে দেখি রনি আসেনি। আমরা দূর থেকে যে দৃশ্য দেখলাম হয়তো কাছ থেকে সে আরও ভয়াবহ কিছু দেখেছে।

রনি মাঠে নাকি কবরস্থানে সেটা আমরা কেউ জানিনা। আবার ভয়ে কেউ মাঠেও যেতে রাজি না। শেষমেশ আমাদের পাড়ার একজন সাহসী বড়ভাই রনিকে আনতে গেলেন। আমরাও উনার সাথে সাথে গেলাম। গিয়ে দেখি রনি মাঠের মাঝখানে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে। বড়ভাই রনিকে উনার কাঁধে করে বাড়ি পর্যন্ত দিয়ে আসলেন।

সে রাতে রনির প্রচণ্ড জ্বর আসলো। সারা গায়ে কাঁপুনি শুরু হল। রাতের মধ্যেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হল। অতঃপর জেলা হাসপাতালে তাকে ভর্তি করানো হল। কিছুদিন যাবত রনির খুব চিকিৎসা চলতে থাকলো। কিন্তু তার অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছিল না। দিনদিন রনির অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকলো। ডাক্তার কি চিকিৎসা করাবেন নিজেই ভেবে পাচ্ছিলেন না। ঔষধাদি চলতে থাকলো কিন্তু রনির অবস্থা দিনেদিনে আরো অবনতি হতে থাকলো। কোনো ওষুধপত্র কাজ করছিল না। শেষমেশ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পঞ্চম দিনের মাথায় রনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো।

রনির আম্মু শোকের আবেগে এমন অবস্থা করলেন যে আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। রনির সাথে উনারও প্রাণটা বুঝি যায়। পুরো গ্রাম শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়লো। রনির কবরটা আমাদের মাঠের পাশে যে কবরস্থানটা আছে ওখানেই দেওয়া হল। কবরস্থানের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় তাঁর কবরটা দেওয়া হল। কবরস্থানের দিকে তাকালে রনির কবরটা সবার আগে দেখা যায়।

রনি মারা যাওয়ার পর আমাদের গ্রাম থেকে ফুটবল খেলা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। ভয়ে আমরা কেউ ফুটবল খেলার নামও নিতাম না।

জনি আর রনি দুই ভাই রাতে একসাথে ঘুমাতো। রনি মারা যাওয়ার পর জনি কেমন জানি হয়ে যায়। সবসময় একা একা আর মনমরা থাকে। কারো সাথে তেমন মিশে না। রাতে একা থাকে। মাঝেমধ্যে মধ্যরাতে সে নাকি তাদের ফ্লোরে ফুটবল খেলার আওয়াজ শুনতে পেত। কে যেন ফ্লোরে ফুটবল খেলছে। ব্যাপার হল রনি জীবিত থাকতে প্রায়সময় ফ্লোরে ফুটবল অনুশীলন করতো।


এরপর বর্ষা পেরিয়ে শীত আসে। শীত শেষে বসন্ত। কিন্তু কারো মনে আর ফুটবল খেলার ঝোঁক আসেনা। এভাবে একটা বছর শেষ হয়ে আরেকটা বছর চলে আসলো। আমাদের মন থেকে সমস্ত ভয় আস্তে আস্তে কেটে যেতে থাকলো।

একদিন বিকেলে আমরা আবার খেলার জন্য মনস্থির করলাম। বরাবরের মতো আমি আর মামুন মিলে জনিকে ডাকতে গেলাম। আজকে আর কেউ রনির জন্য অপেক্ষা করছেনা। জনি প্রথমে খেলতে রাজি হয়নি। কিন্তু আমার আর মামুনের জেরার মুখে পড়ে শেষ পর্যন্ত খেলতে রাজি হল।

শীতের পড়ন্ত বিকেলে আমরা সবাই মাঠে খেলার জন্য উপস্থিত। খেলা শুরু হওয়ার সময় বল একেবারে মাঠের মাঝখানে থাকে। জনির একটা অভ্যাস ছিল খেলা শুরু হলে বলটা মাঠের মাঝখান থেকে সজোরে বিপক্ষদলের গোলপোস্টের দিকে লাথি মারতো। ওইদিনও সে একইভাবে গোলপোস্টের দিকে সজোরে লাথি মারলো। কিন্তু লাথি মারার সাথে সাথে পায়ে হাত দিয়ে বিকট শব্দে মাগো বলে মাঠে লুটিয়ে পড়লো। আমরা মাঠে উপস্থিত সবাই ভয় পেয়ে গেলাম। সে শুয়ে শুয়ে অঝোর ধারায় কান্না করতে থাকলো। অজানা আশঙ্কায় আমাদের মন কাঁপতে থাকলো।

সেদিন রাতে জনিরও সমস্ত শরীর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসলো। আর পায়ে ছিল প্রচণ্ড রকমের ব্যথা। সারারাত সে বিভিন্ন রকমের প্রলাপ বকতে লাগলো।

শেষরাতে তাঁর জ্বর খুব বেড়ে গেল। উপায়ান্তর না দেখে পরেরদিন সকালে জনিকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। ডাক্তার ওষুধপত্র দিলো কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছেনা। জনির অবস্থার দিনদিন অবনতি হতে থাকলো। তার পা ভয়ানক রকম ফুলে গেল। ব্যথা-যন্ত্রণায় জনি দিনরাত কাতরাতে থাকলো। এরকম কিছুদিন হাসপাতালে থাকার পর জনিও তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে পরপারে চলে গেল।

রনি, জনি দুই ভাই মারা যাওয়ার পর আমাদের গ্রাম থেকে ফুটবল খেলা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এখন আর কেউ স্কুল ছুটির পর ফুটবল খেলার জন্য বলেনা। আমি আর মামুনও ওদের ডাকতে যাইনা। যেদিন জনি মারা গেল ওইদিন থেকে ওদের পরিবারের সাথে আমাদের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

ধন্যবাদ সবাইকে। 

জনির কবরটা দেওয়া হয়েছিল রনির কবরের পাশেই। কবরস্থানের দিকে তাকালে পাহাড় সমান উঁচু কবরগুলো আজো সবার আগে চোখে পড়ে।

© Kish Warul Kiyum Tushar
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url