আজকের মেধাবী আর সেকালের বীর ১৯৭১

ঠুক ঠুক ঠুক!!!

রাত দুটা বেজে ত্রিশ মিনিট। আমি থাকতাম আমাদের ঘরের একেবারে সামনের রুমটাতে।

এতো রাতে কে আসতে পারে?? মনেমনে প্রশ্নটা করে দরজা খুলে দিলাম। দরজা খোলার সাথে সাথে দুজন পাকিস্তানি সৈন্য আমাদের ঘরে ঢুকে পড়লো। কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার মাথার দিকে একটা বন্দুক উঁচিয়ে ধরে ওদের সাথে যেতে বললো।
আমি একটু কথা বলতে যাবো কিন্তু ওরা হুংকার দিয়ে কোনো কথা না বলে ওদের সাথে যেতে বললো। আমি জানতাম ওরা আমাকে কোনো ভালো কাজের জন্য নিয়ে যাচ্ছেনা। তাই চাইছিলাম পরিবারের সবার সাথে অন্তত একবার দেখা করে যাই। কিন্তু ওরা সে সুযোগ দিলোনা।

হানাদারদের সাথে যেতে যেতে আমার পরিবারের কথা ভাবতে লাগলাম।

পরেরদিন সকালে পরিবারের কেউ আমাকে আমার বিছানায় দেখতে পাবেনা। আমাকে বিছানায় না দেখে পরিবারের সবাই কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করবে। এরপরেও না পেলে ব্যাপকভাবে খোঁজাখুঁজি করবে। প্রতিবেশীদের খবর দিবে। সবাই চারিদিকে খোঁজাখুঁজি করতে থাকবে। সবার মনে আস্তে আস্তে পাকিস্তানিদের কথা ঘুরপাক খাবে। ভাববে হানাদারেরা আমাকে হয়তো ধরে নিয়ে গেছে। এসব ভেবে ভেবে সবাই একটি অনাকাঙ্ক্ষিত মুহূর্তের জন্য তৈরি হতে থাকবে। যদি এরপরেও না পায় তবে কান্নার রোল পড়ে যাবে।

আব্বু, আম্মু আর ভাইবোনরা একটু বেশিই কান্না করবে। ওদের কান্না দেখে প্রতিবেশীরাও চোখের পানি মুছবে। আমার বন্ধুরা আব্বু- আম্মুকে শান্ত করতে চেষ্টা করবে। কিন্তু কিছুতেই তারা শান্ত হবেন না।

হানাদাররা ওদের আস্তানায় নিয়ে গিয়ে আমাকে রশি দিয়ে একটা গাছের সাথে শক্ত করে বেধে নিলো। এরপর একজন সৈন্য 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ' বলতে বললো। কিন্তু আমি রাজি হওয়ার মতো না। আমি সোজাসুজি বলে দিলাম আমাকে মেরে ফেললেও বলবো না। সে আমাকে দ্বিতীয়বারের মতো পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলতে বললো। আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে 'জয় বাংলা' বললাম। এটা ওদের একেবারেই সহ্য হলোনা। সাথে সাথে বন্দুকের বিকট শব্দ হলো।

আমি চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে গেলাম। আমার পরিবারের সবাই সাথে সাথে দৌড়ে চলে এলো। সবার মুখে একই প্রশ্ন। কি হয়েছে? কি হয়েছে? খারাপ স্বপ্ন দেখলি না তো??

আমি স্বর নিচু করে না বললাম। এরপর বালিশে মাথা চেপে দিয়ে ওপাশ ফিরে চোখ বন্ধ করে রইলাম। আর ভাবতে লাগলাম:- ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় এরকম হাজার হাজার দামাল ছেলেদের পাকিস্তানিরা ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছিল। অনেক ছেলে আছে যাদের ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে মা ঘুমাতে গিয়েছিলেন। কিন্তু এরপর সেই ছেলের মুখ আর দেখেননি। এর মতো কষ্ট আর কিছু হতে পারেনা। ওসব মায়েদের কথা ভাবতে ভাবতে আমার নিজের চোখেও একটু পানি আসলো। বালিশে চোখ মুছে নিলাম।

ঘুমাবার চেষ্টা করলাম কিন্তু ঘুম আর আসতে চায়না। ইসস!! আম্মু পাশে থাকলে ভালো হতো। ঘুম পাড়িয়ে দিতে দিতে গল্প শোনাতেন। আমিও নাহয় আমার মৃত্যু থেকে বেঁচে ফেরার গল্পটা মাকে শোনাতাম। কিন্তু সে গল্পটা কি আম্মুকে বলা ঠিক হবে? না!! বলার দরকার নেই। আমার স্বপ্নের কথা আমার কাছেই থাক।।।



,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,লেখক তুসার।
ধন্যবাদ সবাইকে 
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url